বারাকাত সাহেব চুপচাপ বসে আছেন ঘরের এক কোণায়। তাঁর মনটা খুব একটা ভালো নেই। নতুন বাসায় আজ তাঁর এক সপ্তাহ হলো। এদিনে সাধারণত সাত মার্চের ভাষণ শোনা তাঁর একটি পুরনো অভ্যাস। কিন্তু তাঁর চির পরিচিত সিডি প্লেয়ারটি তাঁর নতুন বাসাতে নেই। ওগুলো এখন বাক্সবন্দি।

সাত বছর আগে বারাকাত সাহেব অরলান্ডোতে আসেন। টেনেসির বিশাল লেকের ওপর প্রাসাদোপম বাড়ি ছেড়ে অরলান্ডোতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো তাঁর। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর অতি প্রিয় বাড়িটিও তাঁর কাছে কষ্টের হয়ে গেল। যে বাড়িতে লোকজন গমগম করতো। প্রতি সপ্তাহে লেগে থাকতো বড় বড় সব দাওয়াত, সে বাড়ি জনশূন্য হয়ে গেল।
বাংলাদেশ আর ভারত থেকে অনেক নামিদামি শিল্পী তাঁর বাসায় আসতেন। মানুষ ভেঙে পড়তো তাঁর বাড়িতে। যখন সেসব মধু ফুরিয়ে গেল, মধুর মাছিও হারিয়ে গেল। যখন তাঁর একমাত্র ছেলে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন চিকিৎসক হিসেবে কাজ নিলেন, তখন তিনি তাঁর ভাগ্নের আমন্ত্রণে অরলান্ডোতে একটি ছোট বাড়ি কিনে এখানে চলে এলেন।
বিশাল লেকের ওপর বাড়ি। বাড়ির পেছনে বিশাল দুটো ওক গাছ। ওকের ছায়াতে তাঁর বসার জায়গা। একটা দোলনা। দুটো চেয়ার তার পাশে। ওখানে বসে লেকের দিকে চেয়ে সব পুরনো দিনের স্মৃতি খুঁজে বেড়াতেন তিনি।
আমার সঙ্গে দেখা হয় কালেভদ্রে। ক’মাস আগে আমাদের বাসায় বেড়াতে এলেন। বললেন, ‘আজকাল হাঁটতে কষ্ট হয়। অনেক কিছু ভুলে যাই। ভাবছি এএলএফে (অ্যাডাল্ট লিভিং ফ্যাসিলিটি) চলে যাবো।’ এএলএফ হলো নার্সিং হোমের উন্নত সংস্করণ। এক রুমের ছোট বাড়ি। এক চিলতে বসার ঘর, একটা সোফা পাতা তাতে। একটা টেলিভিশন, ইন্টারনেট লাগানো আছে। অপরিহার্য জিনিস ছাড়া বাহুল্য কিছু রাখার জায়গা নেই সেখানে। আমি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনার প্রিয় বইগুলোর কী হবে?’ উনি হেসে বললেন, ‘তোমার বাসায় জায়গা থাকলে তুমি নিতে পারো ওগুলো।’

arnolad

গত পরশু বারাকাত সাহেব জানালেন যে, তিনি অরলান্ডোর কাছাকাছি একটি সুন্দর এএলএফে চলে এসেছেন। তারা তাঁর সব অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র একটি গুদামে রেখে দিয়েছে। তিনি বললেন, ‘তোমার যা যা পছন্দের এসে নিয়ে যেও ওখান থেকে।’ আমি হেসে বললাম, ‘আমার ঘরে তো জায়গা নেই। তবে কাল আসবো আপনার সাথে দেখা করতে।’

বারাকাত সাহেবের খাবার-দাবারে তেমন কোনো সমস্যা নেই। তাঁকে একটি বৈদ্যুতিক গাড়ি দেওয়া হয়েছে। তিনি ঘুরেফিরে বেড়াতে পারেন। একজন সেবিকা এসে দিনে তিনবার তাঁর দেখভাল করে যায়। তাঁর ছেলে দিনে দু’বার ফোন করেন। আজও তাঁর ছেলেকে বিয়ে করার জন্য তাগিদ দিয়েছেন তিনি।

এজন্য মনটা খারাপ তাঁর। মুন্নি বেগম, তাঁর স্ত্রী মারা যাবার আগে বলেছিলেন, ‘আমি তো পারলাম না বিয়ে থা করাতে ওকে, দেখ তুমি কিছু করতে পারো কিনা।’ মুন্নি বেগমের কথা বোধ হয় রাখতে পারবেন না তিনি।
যাবার সময় আমাকে বারাকাত সাহেব বললেন, ‘দেখো, সারা জীবন বোধ হয় কেবল অপ্রয়োজনীয় কাজই করলাম, আর অপ্রয়োজনীয় জিনিসই কিনলাম। আমার ঘর তো কেবল ছোটই হচ্ছে দিনদিন।’

অরলান্ডোর আলো ঝলমল রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে ঘরে ফেরার পথে মনে হলো- কতো অপ্রয়োজনীয় জিনিসেই না রাঙানো আমাদের জীবন। আমার গাড়ি ছুটে চলছে। আমি আমার জীবনের অপ্রয়োজনীয় জিনিসের সমীকরণ মেলাতে পারছি না।